বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারী কমেছে

বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারী কমেছে

দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারী কমেছে

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করে পরিকল্পিত পরিবার গঠনে এক সময় দেশে সাফল্য ছিল বেশ। তবে সেই সাফল্যে যেন ছেদ পড়েছে। কমেছে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারীর সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিকল্পিত পরিবার গঠনের দিকে আর সরকারের দৃষ্টি নেই। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর দামও অনেক বেড়েছে। প্রচার-প্রচারণায় তৈরি হয়েছে ব্যাপক ঘাটতি। আর এসব কারণে কমছে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৩ সালের ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসে’র তথ্য বলছে, ২০২২ সালে দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার ছিল ৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যা পরের বছরে কমে গেছে। ২০২৩ সালে ওই হার হয়েছে ৬২ দশমিক ১ শতাংশ। বিবিএস গত রোববার এই ফল প্রকাশ করে

প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, শহর-গ্রাম উভয় এলাকাতেই জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহাকারী কমেছে। তবে শহরের চেয়ে গ্রামে কমেছে বেশি (১ দশমিক ৩ শতাংশ)। গ্রামের ৬২ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ ২০২২ সালে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করলেও ২০২৩ সালে তা কমে হয়েছে ৬১ দশমিক ৬ শতাংশ। বিবিএসের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ফল বলছে, ২০২২ সালে শহরের ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন, যা ২০২৩ সালে হয়েছে ৬৩ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরে শহরাঞ্চলে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কমার হার শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ।

বিবিএসের তথ্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহাকারী কমার কিছু কারণ তুলে ধরেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. মনজুর হোসেন। সমকালকে তিনি বলেন, ‘একদিকে দেশে ধনি শ্রেণির পরিবারে সন্তান নেওয়ার প্রবণতা কিছুটা বেড়েছে। অন্যদিকে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। এক বছরে কয়েকটি কোম্পানি জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর দাম প্রায় দ্বিগুণ করেছে। এর প্রভাব পড়েছে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হারের ওপর।’ তার মতে, এখন দীর্ঘমেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে কম। অনেকে মাঝপথে ব্যবহার করে আবার ছেড়ে দিচ্ছে।

বিবিএসের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস বলছে, জন্মনিয়ন্ত্রণের ‘যে কোনো পদ্ধতি’ ব্যবহারকারী টানা দুই বছর ধরে কমেছে। ২০২১ সালে এটি ব্যবহারকারীর হার ছিল ৬৫ দশমিক ৬ শতাংশ, যা কমে ২০২২ সালে হয় ৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ। পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে তা আরও কমে হয় ৬২ দশমিক ১ শতাংশ। বিবিএসের উপাত্ত অনুযায়ী, জন্মনিয়ন্ত্রণের আধুনিক অনেক পদ্ধতি দেশে চালু হলেও সেগুলোর ব্যবহার দিন দিন কমছে। যেমন– ২০২১ সালে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার ছিল ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০২২ সালে তা কমে হয় ৬২ দশমিক ৩ শতাংশ। গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে তা আরও কমে হয়েছে ৬১ শতাংশ। তবে সনাতন পদ্ধতি ব্যবহারকারী ২০২২ সালের তুলনায় পরের বছর কিছুটা বেড়েছে। ২০২২ সালে সনাতন পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার ছিল ১ দশমিক শূন্য শতাংশ, যা বেড়ে ২০২৩ সালে হয় ১ দশমিক ১ শতাংশ।

জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সরকারের দৃষ্টি যে কমে গেছে, বিবিএসের জরিপে তার প্রমাণ মিলেছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী নিয়ে মাঠকর্মীরা আর বাড়ি বাড়ি যান না। প্রচারণাও নেই। কিন্তু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে এদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। বাজেটেও বরাদ্দ বাড়াতে হবে।’ পশাপাশি সেবার মানোন্নয়ন ও প্রচার বাড়াতে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের কথা বলেন তিনি।

বিবিএসের উপাত্ত বলছে, গ্রামের তুলনায় শহরে নারীদের মধ্যে ইমার্জেন্সি পিল ব্যবহারের হার বেশি। গত ১২ মাসে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের ইমার্জেন্সি পিল ব্যবহারের হার ছিল ১ দশমিক ০৫ শতাংশ। গ্রামে এই হার শূন্য দশমিক ৮৮ শতাংশ হলেও শহরে তা ১ দশমিক ৬১ শতাংশ।

আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সেহেরীন এফ সিদ্দিকা সমকালকে বলেন, ‘গ্রামাঞ্চলে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ মেয়ের কিশোরী বয়সে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তারা জানেই না, আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কী। আরেকটি বড় সমস্যা হলো, বিরাট সংখ্যক নারী মনে করে– দরকার হলে ইমার্জেন্সি পিল খেয়ে নেব। তারা জানেন না, এটি কার্যকর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নয়। ইমার্জেন্সি পিল বারবার খেলে নানা সমস্যায় পড়তে হয়– তাও তারা জানেন না।’ দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারী বাড়াতে প্রচার-প্রচারণায় জোর দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।